বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কথন বহুদিন ধরে প্রচলিত—❝সিলেট-১ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী বিজয়ী হন, সেই দলই সরকার গঠন করে।❞ ইতিহাসের পাতা উল্টালে এই কথার প্রমাণও মিলবে। তাই জাতীয় রাজনীতির দিক-নির্দেশনা নির্ধারণে সিলেট-১ আসনের গুরুত্ব অন্য যেকোনো আসনের চেয়ে অনেক বেশি।
এই মর্যাদাপূর্ণ আসনকে ঘিরে ইতোমধ্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বড় বড় দল ও ইসলামী ঘরানার দলগুলো প্রায় চূড়ান্ত করেছে তাদের মনোনয়ন প্রক্রিয়া। সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটিকে ইসলামী রাজনীতিতে ‘জমিয়তের রাজধানী’ বলা হয়। এখান থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী ইসলামী রাজনৈতিক ধারার নেতৃত্ব বারবার উঠে এসেছে।
এ আসনে বিএনপির মনোনয়ন দৌড়ে রয়েছেন দলটির চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা—আরিফুল হক চৌধুরী ও খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির। নগর রাজনীতিতে আরিফুল হক চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরে জনপ্রিয় মুখ। সিলেট সিটি করপোরেশনের দুই মেয়াদে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে নগরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তিনি ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন। রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা ও সরকারের সমালোচনায় সাহসী কণ্ঠ হিসেবে তিনি দলের মাঠের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছেন। অপরদিকে, ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি থেকে ধানের শীষ প্রতীকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হলেও খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির ক্লিন ইমেজের রাজনীতিক হিসেবে জনমনে গ্রহণযোগ্য অবস্থান গড়ে তুলেছেন। দলের অভ্যন্তরেও তার অবস্থান বেশ দৃঢ় বলে জানা গেছে।
অন্যদিকে, ইসলামী দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে আগে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলের মনোনীত প্রার্থী মাওলানা হাবীবুর রহমান ইতোমধ্যেই রাজপথ ও জনসংযোগে ব্যস্ত সময় পার করছেন। দাড়িপাল্লা প্রতীকের পক্ষে শহর ও গ্রামে সাড়া ফেলতে সক্ষম হচ্ছেন তিনি। জামায়াতের স্থানীয় নেতারা দাবি করছেন, সিলেট-১ আসনে তাদের ভোটের হার বাড়ছে।
ইসলামী ঐক্যের অন্যান্য ধারার প্রার্থীরাও নিজেদের অবস্থান থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খেলাফত মজলিস থেকে দলের সিলেট মহানগর সভাপতি মাওলানা তাজুল ইসলাম হাসান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস থেকে সিলেট জেলা সাধারণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল ফখরুল ইসলাম এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) থেকে কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেতা এহতেশাম হক প্রার্থী হচ্ছেন বলে জানা গেছে।
তবে সব আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মনোনীত প্রার্থী মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরী। ইসলামী রাজনীতির ঐতিহ্য ও নৈতিকতার ধারক এই নেতা দীর্ঘদিন ধরে মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয়। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে মানুষের কল্যাণ ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করার যে বুদ্ধিবৃত্তিক চেষ্টার ধারা জমিয়ত বহন করে, তার অন্যতম প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। দলের ঘরোয়া কার্যক্রম থেকে শুরু করে ভোটার সংযোগ—সবখানেই তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। তরুণ আলেম, ব্যবসায়ী শ্রেণি ও শিক্ষিত পেশাজীবীদের মধ্যেও তিনি আলোচনার শীর্ষে।
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতে ইসলামীর কিছু নেতাকর্মীর ধর্মীয় বিষয়ে বিতর্কিত মন্তব্য ও নেতিবাচক সমালোচনার কারণে ধর্মপ্রাণ নাগরিকদের একাংশ তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বলেও স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনা রয়েছে। সেই প্রেক্ষাপটে সিলেটের তৃণমূল থেকে শুরু করে সর্বস্তরে জমিয়তের সংগঠিত কার্যক্রম ও বিশাল জনশক্তির কারণে মাওলানা আব্দুল মালিক চৌধুরীর জয়ী হওয়ার পথ অনেকটাই সুগম বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষকরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সিলেট-১ আসনে ইসলামী রাজনীতির এই বহুমাত্রিক উপস্থিতি আসন্ন নির্বাচনে একটি ব্যতিক্রমী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্ম দেবে। তবে ইতিহাস, সংগঠন, আদর্শ ও নেতৃত্বের মেলবন্ধনে জমিয়তের প্রার্থীকেই অনেকে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় প্রার্থী হিসেবে দেখছেন।