সিলেট ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে ভাদ্র, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই রবিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

জামালগঞ্জে ১৩ গ্রামে শিক্ষার আলোহীন ৯ হাজার মানুষ

ডেস্ক নিউজ
প্রকাশিত আগস্ট ৩১, ২০২৫, ০৬:২৭ অপরাহ্ণ
জামালগঞ্জে ১৩ গ্রামে শিক্ষার আলোহীন ৯ হাজার মানুষ

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি::

ধান ও মাছের ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার হাওরাঞ্চল জামালগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা ক্ষেত্রে ভয়াবহভাবে পিছিয়ে রয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হলেও উপজেলাটির ছয়টি ইউনিয়নের ১৩টি গ্রামে এখনো কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই।

বিদ্যালয়বিহীন গ্রামগুলো হলো- জামালগঞ্জ উত্তর ইউনিয়ন: মমিনপুর, উত্তর লক্ষীপুর, হোসেনপুর, ইনসানপুর, ঝুনুপুর ও মাছুমপুর, মুসলিমপুর, সদরকান্দি। ফেনারবাঁক ইউনিয়ন: রসুলপুর ও যশমন্তপুর। সাচনা বাজার ইউনিয়ন: নজাতপুর ও নুরপুর (আশ্রয়ণ প্রকল্প)। ভীমখালি ইউনিয়ন: চান্দেনগর।

জামালগঞ্জ পরিসংখ্যান অফিসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুসারে এসব ১৩ গ্রামে পরিবার সংখ্যা ১ হাজার ৬৭৪টি এবং মোট জনসংখ্যা প্রায় ৯ হাজার ৩৮ জন। এর মধ্যে প্রায় ৩ হাজার কিশোর-কিশোরী প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে রয়েছে।

বিদ্যালয় না থাকায় এসব গ্রামের শিশুরা মসজিদের মক্তবে অল্প পড়াশোনা করার পর কৃষিকাজ বা বিভিন্ন শিশু শ্রমে যুক্ত হচ্ছে। শিক্ষার সুযোগ না থাকায় বাড়ছে শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ ও মাদকাসক্তির মতো সামাজিক সমস্যা।

মমিনপুর গ্রামের কাদির মিয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় আমরা দিশেহারা। শত শত শিশু পড়তে চায়, কিন্তু স্কুল নেই। হয়তো মরে যাব, তবু স্কুল দেখে যেতে পারব না।”

৭৫ বছরের মুক্তার মিয়া বলেন, “নির্বাচনের আগে সবাই স্কুল করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। কিন্তু ভোট শেষে আর কেউ স্কুলের খোঁজ নেয় না।”

শিশু মুন তাহার বেগম (১৩) জানান, নদী পাড়ি দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে তাকে অন্য গ্রামে পড়তে যেতে হয়।

“উত্তর লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা শাহ জাহান মিয়া বলেন, ‘আমাদের গ্রামে কোনো বিদ্যালয় না থাকায় শিশুরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই অবস্থায় তাদের ভবিষ্যৎ ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা চাই, আমাদের গ্রামে একটি স্কুল স্থাপন হোক-যাতে আমাদের সন্তানরাও সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।'”

“আমরা হোসেনপুর গ্রামের বাসিন্দা। কৃষিকাজ করেই আমাদের সংসার চলে,” বলেন আব্দুল গনি। “আমাদের ছেলে-মেয়েরা স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বে-এই আশাতেই বেঁচে আছি। কিন্তু আশেপাশে যদি কোনো স্কুলই না থাকে, তাহলে তারা পড়বে কীভাবে? ভবিষ্যৎ গড়বে কী করে?”

পাভেল মিয়া (১০) স্বপ্নের কথা জানিয়ে বলেন, “আমি পড়াশোনা করে ডাক্তার হতে চাই, কিন্তু আমাদের গ্রামে স্কুলই নাই।”

ইনসানপুর গ্রামের মো. লাল মিয়া বলেন, আমাদের এলাকার ৮টি গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও নেই। আমাদের ছেলে-মেয়েদের অনেক দূর পায়ে হেঁটে গিয়ে স্কুলে যেতে হয়, যা শিশুদের জন্য খুব কষ্টকর এবং ঝুঁকিপূর্ণ। অনেক সময় এই কষ্টের কারণে অনেকেই পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়।

আমরা, এলাকাবাসী, জোর দাবি জানাচ্ছি-এই অঞ্চলে অন্তত একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হোক। শিক্ষা আমাদের সাংবিধানিক অধিকার, আর সেই অধিকার থেকে আমাদের বঞ্চিত করা অন্যায়।

মমিনপুর গ্রামবাসীর সূত্রে জানা যায়, স্থানীয়রা ২০০০ সালে ৩৩ শতক জায়গা কিনে বিদ্যালয়ের জন্য নামজারি করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রভাবশালী আবু হানিফ গং ওই জমি দখল করে রাখায় বিদ্যালয় নির্মাণের উদ্যোগ বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এবিষয়ে গ্রামবাসীর পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন শমসের আলী।

জামালগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পীযুষ কান্তি মজুমদার বলেন, “বিদ্যালয় না থাকায় অনেক শিশুই ঝরে পড়ছে। মমিনপুরে বিদ্যালয়ের জমি রয়েছে, আমি এ বিষয়ে অবগত। শিগগিরই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে প্রস্তাবনা পাঠানো হবে। শিক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই, তাই বিদ্যালয়বিহীন গ্রাম উপজেলার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক।”

সম্প্রতি জামালগঞ্জে পরিদর্শনে এসেছিলেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার। তখন তিনি এ বিষয়ে বলেন, “হাওরাঞ্চলে আবাসিক স্কুল নির্মাণের পরিকল্পনা শিক্ষকদের আগ্রহ না থাকায় বাস্তবায়িত হয়নি। তবে বিদ্যালয়বিহীন গ্রামগুলোতে দ্রুত প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।”

স্থানীয়দের একমাত্র দাবি- যত দ্রুত সম্ভব এসব গ্রামে বিদ্যালয় স্থাপন করা হোক, যাতে নতুন প্রজন্ম শিক্ষার আলোয় আলোকিত ভবিষ্যৎ গড়তে পারে।

সংবাদটি শেয়ার করুন