ড. এস এম শাহনূর :
“আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো,
তবু আমারে দিবো না ভুলিতে।”
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতার এই পঙক্তিকে যেন সত্যি করে গেছেন। তিনি বিদ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি—বাংলা সাহিত্য ও সংগীত জগতের এক অমর নক্ষত্র। তাঁর অবদান অনস্বীকার্য, চিরস্মরণীয়।
দুঃখজনকভাবে আজও আমাদের পাঠ্যপুস্তক ও প্রচারমাধ্যমে কবির জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ নিয়ে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছাপা হচ্ছে—যা কোনো সচেতন মানুষ মেনে নিতে পারে না।
জন্ম ও মৃত্যু : প্রকৃত তারিখ:
জন্ম : ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ২৪ মে ১৮৯৯)
মৃত্যু : ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ (ইংরেজি ২৯ আগস্ট ১৯৭৬)
অতএব, কবির জন্ম ও মৃত্যু দিবস স্থির হবে বাংলা সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী ১১ জ্যৈষ্ঠ ও ১২ ভাদ্র। ইংরেজি তারিখ কেবল রূপান্তর মাত্র।
জন্মতারিখের বিভ্রান্তি:
পাঠ্যপুস্তকগুলোতে কবির জন্মতারিখ নিয়ে মারাত্মক দ্বৈততা রয়েছে। যেমন—
২০১৮ সালের ৪র্থ শ্রেণির আমার বাংলা (পৃষ্ঠা ৭৭) এবং ৫ম শ্রেণির (পৃষ্ঠা ৯)—জন্মতারিখ ২৫ মে।
২০১৯ সালের ৫ম শ্রেণির আমার বাংলা (পৃষ্ঠা ৯) ও একাদশ শ্রেণির সাহিত্যপাঠ গদ্য ও কবিতা (পৃষ্ঠা ৭৯)—২৫ মে।
৬ষ্ঠ শ্রেণির চারুপাঠ (পৃষ্ঠা ৬৯)—২৪ মে।
২০২০ সালের ৭ম শ্রেণির বাংলা প্রথমপত্র (পৃষ্ঠা ৬৯) ও বাংলা ব্যাকরণ ও নির্মিতি (পৃষ্ঠা ৯৮)—২৪ মে।
৮ম শ্রেণির বাংলা প্রথমপত্র সাহিত্য কণিকা (পৃষ্ঠা ১০, ১০৯)—২৪ মে।
একই শ্রেণির বাংলা দ্বিতীয়পত্র (পৃষ্ঠা ১১০) ও ইংরেজি দ্বিতীয়পত্র—২৫ মে।
অর্থাৎ একেকটি বইয়ে একেক রকম তারিখ!
কিন্তু গবেষণাধর্মী গ্রন্থগুলোতে সঠিক তথ্য স্পষ্ট।
হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত নজরুল ইসলাম কিশোর জীবনী—২৪ মে ১৮৯৯।
আব্দুল আজীজ আল আমান সম্পাদিত নজরুলগীতি অখণ্ড (হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ২০০৬)—২৪ মে ১৮৯৯।
শেখ দরবার আলম সম্পাদিত নবযুগ ও নজরুল জীবনের শেষ পর্যায়—বইয়ের ভেতরে বারবার ২৫ মে বলা হলেও, ৩৮১ পৃষ্ঠায় উল্লেখ আছে ১১ জ্যৈষ্ঠ ২৪ মে ১৮৯৯।
এখানেই আসল বিভ্রান্তি : ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৮৯৯ সালে ইংরেজি তারিখ ছিল ২৪ মে, ২৫ মে নয়।
মৃত্যুতারিখের বিভ্রান্তি:
খ্রিস্টীয় তারিখে কবির মৃত্যুদিন ২৯ আগস্ট ১৯৭৬। বাংলা তারিখে ১২ ভাদ্র ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ।
তাহলে ২৭ আগস্ট কোথা থেকে এলো?
১৯৮৩ সালে ড. মেঘনাথ সাহার প্রস্তাবিত সংস্কার অনুযায়ী নতুন বাংলা পঞ্জিকা চালু হয়। সেই ক্যালেন্ডারে সনাতন পঞ্জিকার ১২ ভাদ্র (২৯ আগস্ট) রূপান্তরিত হয়ে দাঁড়ায় ২৭ আগস্ট।
ফল—কেউ মানছে ২৯ আগস্ট, কেউ মানছে ২৭ আগস্ট।
সংবাদমাধ্যমগুলো সাধারণত ২৭ আগস্টকে নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে প্রচার করে। অথচ তাদের সব খবর ইংরেজি তারিখে প্রকাশিত হয়। সেক্ষেত্রে যদি তারা বাংলা তারিখ (১২ ভাদ্র) অনুসরণ করে, তবে ডেটলাইনেও বাংলা তারিখ ব্যবহার করা উচিত। কিন্তু তা করে না।
দ্বৈত নীতি থেকে বিভ্রান্তি:
আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে—রাষ্ট্রীয় দিবস, শহিদ দিবস (২১ ফেব্রুয়ারি), স্বাধীনতা দিবস (২৬ মার্চ), বিজয় দিবস (১৬ ডিসেম্বর), বঙ্গবন্ধুর শাহাদত দিবস (১৫ আগস্ট)—সবই পালন হয় ইংরেজি তারিখে।
কেবল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের জন্ম-মৃত্যুর ক্ষেত্রে হঠাৎ বাংলা তারিখকে মানা হয়। এ এক দিনের “বাংলাপ্রীতি”ই বিভ্রান্তির মূল।
অথচ প্রকৃত সত্য হলো—কবি যেদিন জন্মেছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন, সেই দিনটি বাংলাতেই নির্ধারিত। ইংরেজি তারিখ শুধুই মিলিয়ে নেওয়ার ক্যালেন্ডার রূপান্তর।
সমাধান:
১. কবি নজরুল ইসলামের জন্ম ও মৃত্যু দিবস নির্ধারিত হবে বাংলা সন তারিখে (১১ জ্যৈষ্ঠ, ১২ ভাদ্র)।
২. ইংরেজি তারিখ তথ্যসূত্র হিসেবে বন্ধনীতে রাখা যেতে পারে।
৩. পাঠ্যবই, সংবাদমাধ্যম, বিশ্বকোষ—সবখানেই এ নিয়ম প্রতিষ্ঠিত হোক।
৪. সরকার ও বাংলা একাডেমিকে এগিয়ে এসে এ বিভ্রান্তি দূর করতে হবে।
উপসংহার:
কাজী নজরুল ইসলাম কেবল একজন কবি নন, তিনি আমাদের জাতীয় কবি, আমাদের গৌরব।
তাঁর জন্ম ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬, মৃত্যু ১২ ভাদ্র ১৩৮৩—এই বাংলা তারিখই তাঁর চিরস্মৃতি।
ইংরেজি ২৪ মে ও ২৯ আগস্ট কেবল এর আন্তর্জাতিক অনুবাদ।
অতএব, নজরুলের জন্ম ও মৃত্যু দিবস চিহ্নিত হবে—বাংলা সনের তারিখে। এভাবেই তাঁর স্মৃতির প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন করা সম্ভব।
লেখক: আন্তর্জাতিক কবি ও গবেষক