সিলেট ৩রা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২০শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৭ই জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

খুনের রাজধানী সিলেটের কানাইঘাট হাফিজ শিহাবকে হত্যা: প্রতিবাদ সমাবেশ অব্যাহত: মূল খুনিরা অধরা

admin
প্রকাশিত মে ৩১, ২০২৫, ০৭:৩৮ পূর্বাহ্ণ
খুনের রাজধানী সিলেটের কানাইঘাট  হাফিজ শিহাবকে হত্যা: প্রতিবাদ সমাবেশ  অব্যাহত: মূল খুনিরা অধরা

আব্দুল হালিম সাগর :: সিলেট জেলার একটি শান্ত জনপদ কানাইঘাট উপজেলা। যে উপজেলায় সবচেয়ে বেশী আলেম উলামার স্মৃতি বিজড়িত উপজেলা। কিন্তু হঠাৎ কয়েক বছর থেকে এই শান্ত জনপদটি অশান্ত হয়ে উঠেছে। কানাইঘাটকে এখন খুনের রাজধানী বললেও ভূল হবেনা। কারন প্রতিমাসে কানাইঘাট উপজেলায় দুই-চারটি খুনের ঘটনা ঘটে থাকে। চুন থেকে পান খসলেই নিরপরাধ মানুষকে দিতে হয় তাজা প্রাণ। বাস্তব নির্মমতা হচ্ছে কানাইঘাটে খুনের ঘটনার পর খুনিরা নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে, যে কোন অজ্ঞাত স্থানে। যদিও পুলিশ লোক দেখানো অভিযান চালিয়ে দুই একজন ঘাতকে আটক করে মাঝে মধ্যে। খুনের মামলার আর্জির দূর্বলতা আর দালালদের কারনে ঘাতকরা সহজেই আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসে। ফলে অপর খুনিরা খুনের ঘটনা ঘটাতে উৎসাহিত হয়। কারন খুন করলে দুই-চার মাস জেলে থাকতে হয়।এর থেকে কঠিন শাস্তি এখনো পরিরক্ষিল হয়নি। ফলে আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে যায় ঘাতকরা। এসব খুনের মামলার বিচারকার্যও সম্পন্ন হতে কয়েক বছর সময় লাগে।

আর বিচার কার্য দেরীতে হওয়ার ফলে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা তাদের সাক্ষ্য দিতে এলোমেলো করে ফেলেন। যার ফলে বিচারের ফাঁক-ফুকর দিয়ে আসল অপরাধীরা সহজে রক্ষা পেয়ে যায়। অপর দিকে খুনের ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষীদের সঠিক সাক্ষ্য দিতে প্রভাবিত করেন এলাকার মুড়ল নামের ঘুষখোর ধান্ধাবাজরা। তারা খুনের মুটিভ পরিবর্তন কর,তে আসল খুনের ঘটনাটি আড়াল করতে, গোষ্ঠীগত দ্বন্ধকে সামনে নিয়ে আসেন।আসল ঘটনার ভিন্ন রুপ দিয়ে উপন্যাস সাজিয়ে ফেলেন। ফলে খুনের ঘটনার প্রকৃত বিচার হয় না। এখানে আরেকটি পক্ষ বের হয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বা আয়ূকে ম্যানেজ করতে। আর নেতা নামের অমানুষগুলো থানার ওসি কিংবা সার্কেলকে ম্যানেজ করতে ব্যস্থ হয়ে পড়ে। তারা যে ভাবে হউক পুলিশের তদন্ত কাজকে ভিন্ন পথে নিয়ে যাবেই। ঘাতকরা শুরু করে অর্থ ছিটানো, এতেই অনেক মুড়ল বা দালালের রুটি রুজির ব্যবস্থা হয়ে যায়। তারা মামলার সাক্ষিদের নানা রকম ভাবে চাপ প্রয়োগ করতে থাকে আসল সাক্ষি না দেওয়ার জন্য।

দেখান মিথ্যা পুলিশি হয়রানির ভয়ভীতি। ফলে খুনের প্রত্যক্ষদর্শীরা আর সাক্ষ্য দিতে চায় না। আয়ু বা তদন্তকারী কর্মকর্তা ম্যানেজ হলেই কেল্লাফতে। হাট বাজারে কিংবা নেতার বাসায় বসে খুনের প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য না দিয়ে শুধু সাদা কাগজে সাক্ষির সাক্ষর নিয়ে, নিজের মতো সাক্ষির জবানবন্ধি বসিয়ে আদালতে রির্পোট দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। ফলে আসল খুনিরা সহজেই আদালত থেকে মুক্তি পেয়ে এলাকায় এসে বীরদর্পে ঘুরে বেড়ায় আর হুমকি দেয় একের পর আরেক জনকে খুন করার।

এভাবেই প্রতিনিয়ত কানাইঘাটে বাড়ছে খুন খারাপি সহ অপরাধমূলক ঘটনা। অপর আরেকটি কারণ হচ্ছে থানা সদরের সাথে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা। পর্যাপ্ত পরিবহন আর যোগাযোগে মাধ্যমে না থাকায় পুলিশ ইচ্ছে করলেও অনেক আসামিকে গ্রেফতার করতে পারেনা। ফলে অপরাধীরা একের পর এক অপরাধ করে বেড়ায়। এখানেও পুলিশের সাথে লিয়াজো ম্যানেজ করেন থানার সোর্স, দালাল ও ফড়িয়ারা। তারা টাকার বিনিময়ে এই ইউনিয়নের বিট অফিসারকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে আসেন। যার ফলে বিট অফিসার অন্ধ হয়ে। নিজেই আইনের ভক্ষক হয়ে যান।

যদিও কানাইঘাট থানা একটি বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত। নয়টি ইউনিয়নের সব চেয়ে বড় আর দূরের ইউনিয়ন হচ্ছে ৯নং রাজাগঞ্জ ইউনিয়ন। থানা সদর থেকে এ ইউনিয়নে পুলিশ আসতে সময় লাগে ঘন্টার বেশী। যার জন্য পুলিশ আসার আগেই খুনি বা অপরাধীরা নিরাপদে পালিয়ে যেতে পারে। চলতি বছরে কানাইঘাটে বেশ কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘঠেছে। কিন্তু অনেক খুানিরা নিরাপদে আত্মগোপন করে আছে। আবার অনেকে খুন করে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। সর্বশেষ চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন অপকর্মের প্রতিবাদ করার কারণে শ্রমিক নেতা হাফিজ শিহাব উদ্দিনকে (৪২) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে একই গ্রামে খুন হন আরেক প্র্রবাসী। শিহাবের এ ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিনজনকে আটক করেছে। কিন্তু মূল খুনিদের কাউকে পুলিশ এখনো গ্রেফতার করতে পারেনি। এই খুনের কানাইঘাট থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী হেপী বেগম। মামলায় ৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আর ৪/৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। মামলার আসামীরা হলেন খালপার গ্রামের ইসলাম উদ্দিন (বগলাই) এর চার ছেলে শিব্বির আহমদ (২৭), মোঃ শহিদুল ইসলাম (৩৬), জামাল আহমদ (৪৩) ও কামাল আহমদ (৩৯), খালপার গ্রামের মৃত আনফর আলীর ছেলে লুৎফুর রহমান (৪৮) সহ অজ্ঞাতনামা আরো ৪/৫জন। মামলা সূত্রে জানা যায়, দীর্ঘদিন হতে আসামিগণ এলাকায় চাঁদাবাজীসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িত।

স্থানীয় লোকজন তাহাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায় না। শিহাব উদ্দিন প্রায়ই বিবাদীগনের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন। আর এ প্রতিবাদই কাল হয়ে দাঁড়ায় হাফিজ শিহাব উদ্দিনের। আসামিরা তাকে বিভিন্ন সময়ে খুন করার হুমকি প্রদান করে। ঘটনার দিন ব্রাহ্মনবাড়ীয়া জেলাধীন আশুগঞ্জ এলাকা থেকে রাত অনুমান ৮টার দিকে (এগারো হাজার) ইট নিজ গ্রাম খালপার সমিলের পাশে নিয়া আসেন শিহাব উদ্দিন। ভর্তি ট্রাক হইতে ইট খালাস করার জন্য শিহাব শ্রমিক খোঁজাখুঁজি করে রাত অনুমান সাড়ে ৯ টার দিকে ৩/৪জন শ্রমিক নিয়া আসেন এবং ট্রাক আনলোড করেন । রাত অনুমান ১০টার সময় পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫জন নিয়ে দলবদ্ধ মামলার উল্লেখিত ব্যক্তিরা ধারালো ছুরি, রাম দা, লোহার পাইপ, ইত্যাদি সহকারে শিহাব উদ্দিনকে পূর্ব আক্রোশে অতর্কিত ভাবে আক্রমন করে। আসামিদের উপর্যুপুরি আঘাতে রক্তাক্ত জখম হন হাফিজ শিহাব। এ সময় শিহাব উদ্দিন আত্মরক্ষার জন্য শোরচিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে শিহাবকে উদ্ধার করেন।

এসময় আসামিরা পালিয়ে যায়। পরে আত্মীয় স্বজনও স্থানীয় জনগণ শিহাব উদ্দিন কে চিকিৎসার জন্য সিলেট এমএজি ওসমানি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়া গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষনা করেন। মৃত্যুর আগে হাফিজ শিহাব ঘাতকদের নাম বলে যান। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২৭ মে রাত অনুমান ১০টার দিকে পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে অজ্ঞাতনামা আরও ৪/৫জন নিয়ে দলবদ্ধ হয়ে ছুরি, রাম দা, লোহার পাইপ দিয়ে হত্যা করা হয় হাফিজ শিহাবকে। এদিকে হাফিজ শিহাবের হত্যাকারীদের দ্র্রুত গ্রেফতারের দাবীতে জামায়াতের বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে। হত্যা মামলার আসামীদের গ্রেফতারে গাফলতির প্রতিবাদ এবং হত্যাকান্ডে জড়িত মূল ঘাতকসহ সব আসামিকে গ্রেপ্তার ও সুষ্টু বিচারের দাবীতে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী রাজাগঞ্জ ইউনিয়ন শাখার উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে। গত ২৯ মে বিকালে উপজেলার রাজাগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল পরবর্তী পথসভা করে জামায়াতসহ সাধারণ মানুষ। অপর দিকে ৩০ মে শুক্রবার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের সর্বস্থরের মানুষের ডাকে আরেকটি প্রতিবাদ সভা অনুষ্টিত হয়।

দলমত নির্বিশেষে এলাকার সর্বস্থরের মানুষে সেই সমাবেশে যোগদান করেন। সভায় বক্তারা বলেন, খুনিরা দীর্ঘ দিন হইতে এলাকায় চাঁদাবাজী, চোরাচালানসহসহ বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে জড়িত। তাদের এসব অপকর্মের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন শিহাব উদ্দিন। যার ফলে নির্মম ভাবে খুন করা হয় হাফিজ শিহাবকে। বক্তারা বলেন, ৪৮ ঘন্টা আলটিমেটামের মধ্যে ২৪ ঘন্টা বাকি আছে, এ সময়ের মধ্যে আসামীদের গ্রেফতার না করা হলে কঠোর থেকে কঠোরতর আন্দোলনের ডাক দেন।প্রতিবাদ সভায় বক্তব্য রাখেন কানাইঘাট উপজেলা জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যক্ষ শরীফ আহমদ, কানাইঘাট ইতিহাস-ঐতিহ্য ফোরামের আহবায়ক মুহাম্মদ আব্দুর রহিম উপজেলা জামায়াতের সেক্রেটারি হাফিজ তাজ উদ্দিন, রাজাগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাওলানা শামসুল ইসলাম, রাজাগঞ্জ মাদ্রাসার মুহতামিম মাওলানা মমতাজ উদ্দিন, কানাইঘাট উপজেলা জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি মাওলানা সাদিকুর রহমান, শ্রমিক কল্যান ফেডারেশন কানাইঘাট উপজেলা শাখার সভাপতি হাফিজ ফয়েজ আহমদ, মরহুম শিহাব উদ্দিনের চাচাতো ভাই মাওলানা বাহার উদ্দিন। আজ ৩০ মে রাজাগঞ্জ বাজারের প্রতিবাদ সভায় স্থানীয় এলাকার জনসাধারনসহ, বিএনপি, জামায়াত, জমিয়তসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্তিত ছিলেন।

সংবাদটি শেয়ার করুন