
মানুষের হৃদয় এক বিস্ময়কর ভূমি—যেখানে নেক কাজের বীজ রোপিত হলে তা সুশোভিত বাগানে পরিণত হয়, আর গুনাহের অন্ধকার প্রবেশ করলে তা এক মরুভূমির মতো শুষ্ক ও নিষ্প্রাণ হয়ে পড়ে। মানবজীবন মূলত এক দ্বন্দ্বময় পথচলা—একদিকে আলোকিত কল্যাণের আহ্বান, অন্যদিকে অন্ধকার পাপের প্রলোভন। সত্যপথে অটল থাকার জন্য নেক কাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং গুনাহকে ঘৃণার চোখে দেখা অপরিহার্য। এই অভ্যাসই মানুষকে আল্লাহর ভালোবাসার প্রিয়পাত্র করে তোলে এবং আখিরাতে অনন্ত শান্তির দিকে পরিচালিত করে।
নেক কাজ: হৃদয়ের পরিশুদ্ধি ও কল্যাণের দীপ্ত শিখা
নেক কাজ মানুষের আত্মাকে আলোকিত করে, হৃদয়কে প্রশান্ত করে এবং জীবনকে সার্থকতার পূর্ণতায় পৌঁছে দেয়। এটি কেবল ইবাদত-বন্দেগির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত হওয়া, পরোপকার করা, সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও নেক কাজের অন্তর্ভুক্ত।
আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেন:
“নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন।”(সুরা আল বাকারা: ২৭৭)
আবার অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে:
“যে ব্যক্তি একটি নেক কাজ করে, সে তার দশগুণ প্রতিদান পাবে।” (সুরা আল-আন’আম: ১৬০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
“তুমি তোমার ভাইয়ের প্রতি হাসিমুখে তাকালেও তা সদকাহ হিসেবে পরিগণিত হয়।”(তিরমিজি, হাদিস: ১৯৭০)
অতএব, নেক কাজের গুরুত্ব শুধু আত্মার প্রশান্তি বা ব্যক্তিগত কল্যাণে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি সমাজ ও জাতির জন্য এক অনন্য আশীর্বাদ।
গুনাহ: হৃদয়ের অন্ধকার ও ধ্বংসের কারণ
গুনাহ এমন এক বিষাক্ত বাষ্প, যা মানুষের আত্মাকে দূষিত করে, বিবেককে অবশ করে এবং ধীরে ধীরে তাকে ধ্বংসের অতল গহ্বরে ঠেলে দেয়। প্রথমে পাপ ক্ষুদ্র ও নিরীহ মনে হয়, কিন্তু যখন তা অভ্যাসে পরিণত হয়, তখন তা আত্মার উপর এক অশুভ শৃঙ্খল হয়ে দাঁড়ায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“যে ব্যক্তি মন্দ কাজ করে, তার প্রতিফলও তদনুরূপই হবে, এবং তারা লাঞ্ছিত হবে; তাদের জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো রক্ষাকারী থাকবে না।”(সুরা ইউনুস: ২৭)
রাসুলুল্লাহ (সা.) সতর্ক করে বলেছেন:
“একজন মানুষ যখন কোনো গুনাহ করে, তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। যদি সে তওবা করে, তবে দাগ মুছে যায়; কিন্তু তওবা না করলে ধীরে ধীরে তার হৃদয় সম্পূর্ণ কালো হয়ে যায়।”(তিরমিজি, হাদিস: ৩৩৩৪)
গুনাহ শুধু দুনিয়ায় বরকতহীনতা ও দুশ্চিন্তার কারণ নয়; বরং আখিরাতে কঠিন শাস্তিরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই একজন মু’মিনের কর্তব্য হলো—সে যেন গুনাহ থেকে বেঁচে থাকে এবং নিজেকে আল্লাহর অনুগ্রহের ছায়ায় রাখে।
**নেক কাজের প্রতি আগ্রহ ও গুনাহ থেকে দূরত্ব বজায় রাখার উপায়**
১. আল্লাহর স্মরণ ও তাকওয়া অবলম্বন: যখন অন্তরে আল্লাহর ভয় ও ভালোবাসা সৃষ্টি হবে, তখন নেক কাজ সহজ হয়ে যাবে এবং গুনাহ ঘৃণিত মনে হবে।
২. নেককার ও সৎ মানুষের সঙ্গ: রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, **”মানুষ তার বন্ধুদের দ্বীন অনুযায়ী জীবনযাপন করে, তাই দেখে নাও কার সঙ্গে তুমি মেলামেশা করছো।”** (তিরমিজি, হাদিস: ২৩৭৮)
৩. কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন: পবিত্র কুরআন ও রাসুলের সুন্নাহ মানুষকে নেক কাজের প্রতি আগ্রহী করে তোলে এবং গুনাহ থেকে সতর্ক করে।
৪. নফল ইবাদত ও ইস্তিগফার: নফল নামাজ, রোজা, দোয়া ও ইস্তিগফার আত্মাকে পরিশুদ্ধ করে এবং নেক কাজের প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি করে।
৫. আত্মসমালোচনা ও আত্মজিজ্ঞাসা: প্রতিদিনের কাজ ও চিন্তার মূল্যায়ন করা দরকার, যাতে পাপ থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়।
৬. কোরআন তেলাওয়াত: কোরআন তেলাওয়াত হৃদয়ের মরীচিকা দূর করে। হাদিসে বেশি বেশি কোরআনে কারীম তেলাওয়াত করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন;নিশ্চয় হৃদয়ে মরিচা ধরে, যেভাবে পানি লাগলে লোহায় মরিচা ধরে। তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রসূল! এ মরিচা দূর করার উপায় কী? তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন, বেশি বেশি মৃত্যুকে স্মরণ করা ও কুরআন তিলাওয়াত করা।(মিশকাত; ২১৬৮)
৭. বেশি বেশি মৃত্যুর স্মরণ; মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ করলে আল্লাহর ভয় ও নেক কাজের আগ্রহ হৃদয়ে জাগ্রত হয়। গুনাহের প্রতি অনীহা ও সতর্কতা তৈরি হয়। জান্নাতের আগ্রহ এবং জাহান্নামী সকল কর্মকান্ড থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার স্পৃহা সৃষ্টি হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সালাম বলেছেন;তোমরা বেশী করে স্বাদ হরণকারী বিষয় অর্থাৎ মৃত্যুর আলোচনা (স্মরণ) করবে।(তিরমিজি:২৩০৭)
সর্বোপরি নেক কাজের প্রতি ভালোবাসা ও গুনাহের প্রতি ঘৃণা—এই দুই গুণ অর্জন করলেই মানুষ প্রকৃত কল্যাণের পথে চলতে পারে। এ দুটি গুণ হৃদয়ে ধারণ করলে জীবন হয়ে ওঠে পবিত্র, বরকতময় ও সাফল্যমণ্ডিত। তাই আসুন, আমরা নেক কাজের পথে নিজেকে উৎসর্গ করি, গুনাহ থেকে দূরে থাকি এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকি। কেননা, প্রকৃত সফলতা একমাত্র তাকওয়াবান ও নেককারদের জন্যই নির্ধারিত।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে নেক কাজের প্রতি আগ্রহী করুন এবং গুনাহের পথ থেকে রক্ষা করুন—আমিন!

নেক কাজে আগ্রহ ও গুনাহের প্রতি ঘৃণা: আত্মশুদ্ধির পথ
লেখক:: মুফতী মুহাম্মাদ আসআদ আরবী প্রভাষক দারুন্নাজাত সিদ্দিকিয়া কামিল মাদ্রাসা