
সিলেট ::বন্যা এলে নৌকার কদর বাড়ে। বন্যা না থাকলে বছরে এক দুটির বেশি বিক্রি করা যায় না। চাহিদা কম থাকায় এমন পেশা নিয়ে জীবিকা চলে না। নৌকা তৈরির পাশাপাশি দিনমজুরি করে বৌ বাচ্চা লালন পালন করি। এই পেশায় এখন ঠিকে থাকা দায়। কেউ কখনো খোঁজ খবরও নেয় না। আগের মত খাল বিল নেই, মানুষ নৌকা চালাবে কোথায়? আগে সারা বছর নৌকা তৈরির কাজে সময় পার করতাম। এখন ঘনঘন বন্যা আসায় একটু চাহিদা বেড়েছে, তবে আগেকার মত নয়। ক্রেতা কম, বিক্রি কম, লাভও কম বলছিলেন নৌকা তৈরির কারিগর সুমন আহমদ ও রামানন্দ বৈদ্য।
সুখ দুঃখের কথাগুলোর সাথে অসহায়ত্বের চাপ তাদের চোখে মুখে। আসলেই এখন আর আগের মত নৌকা চলে না। খাল,বিল, হাওড়, জলাশয় বরাট আর দখলের কবলে তাদের পেশায় হতাশা নেমেছে। উন্নয়নের ছোঁয়ায় কমবেশি বদলেছে গ্রামীণ জীবন মান। তবে সময়ের তালে নৌকার প্রয়োজন রয়েছে। সাময়িক ও দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় ঘর থেকে বেরুলে এখনও নৌকার উপর ভরসা করতে হয়। সম্প্রতি বিশ্বনাথে তিন ধাপে বন্যার রেষ এখনো চলমান রয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ, যাতায়াত, ছেলে মেয়েদের স্কুল কলেজে আনা নেওয়া, গোখাদ্য সংগ্রহ সহ কাজগুলো এখন নৌকা দিয়ে সামলাতে হচ্ছে। সাময়িক হলেও নৌকার চাহিদা বেড়েছে। কর্মব্যস্ত আর নৌকা বিকিকিনি করতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন বিশ্বনাথের প্রত্যন্ত এলাকার নৌকা তৈরির কারিগররা।
বিশ্বনাথ উপজেলার ঐতিহ্যবাহী বৈরাগী বাজারে এখন নৌকার হাটে চলছে জমজমাট বেচাকেনা। দুর দুরান্ত থেকে আগত ক্রেতা ও বিক্রেতার উপস্থিত সমাহারে ফিরে এসেছে অতীত দিনের ঐতিহ্য। এখানে সপ্তাহে ২ দিন, রবিবার ও বৃহস্পতিবার নিত্যপূণ্যের হাট বসে। হাটবারে বাজারে উঠে নানান প্রকারের নৌকাও । নৌকার আকার আকৃতি ও কাঠের জাত-প্রজাত বেধে দামের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। ১০ থেকে ১২ হাত লম্বা একেক টা নৌকার দাম ৭ থেকে ১৫ হাজারের ভিতরে। তবে এখন পাতামী ও খেলুয়া নৌকার কদর বেশি। জাম, আম, চাম্বুল, ডেউয়া,জারুল, কোমা গাছের কাঠ দিয়ে নৌকা বেশি তৈরি হয়ে থাকে। জারুল গাছের কাঠের নৌকার দাম সবচেয়ে বেশি। মাকুন্দা নদীর তীরঘেষা বৈরাগী বাজারের ইতিহাস অনেক আগের। এই বাজারে নৌকা বেচাকেনার নামডাকও বহু পুরনো। এখানে ছোট্ট বড় নতুন নৌকা পাওয়া যায়।
বৃহস্পতিবার ১১ই জুলাই সরজমিন ঘুরে দেখা গেছে বিশ্বনাথ উপজেলার প্রসিদ্ধ এই বাজারে নৌকা বেচাকেনার জন্য ক্রেতা ও বিক্রেতাদের উপস্থিতি। নদীর পারে বেধে রাখা আছে সারিসারি নতুন নৌকা। নিজ নিজ নৌকায় বসে আছেন বিক্রেতা। ক্রেতারা দরদাম হাঁকছেন তাদের সাথে। অনেকেই নতুন নৌকা কিনে উচ্ছ্বসিত। এমন একজন ক্রেতা দুলাল আহমদ, তিনি নতুন একটি খিলুয়া নৌকা কিনেছেন। তাঁর সাথে কথা বললে তিনি জানান, বন্যার কারণে রাস্তা ঘাট এখনও পানিতে তলিয়ে আছে। প্রয়োজনীয় কাজ সারতে নৌকা ছাড়া উপায় নাই, ছেলে মেয়েরা স্কুল কলেজে যেতে পারছে না। তাই নৌকা কিনতে এসেছি। তিনি ৭ হাজার ৫ শত টাকায় একটি নৌকা কিনেছেন।
দক্ষিণ সুরমা উপজেলার দাউদ পুর থেকে বৈরাগী বাজারে নৌকা কিনতে এসেছেন সজিব আহমদ। তিনি জানান, বন্যার কারণে নৌকার প্রয়োজন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আমরা ঘর থেকে বেরুতে পারছিনা। আজ নৌকা নিয়ে বাড়ি ফিরবো।
উপজেলার মাখর গাঁও গ্রামের নৌকা বিক্রেতা আবু বক্কর জানান একটি নৌকা তৈরিতে সময় লাগে ৬ থেকে ৭ দিন। আকার আকৃতি বেধে খরচ বাদে ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা লাভ করা যায়। একি বক্তব্য দেন দুলালী সৎপুরের নৌকা বিক্রেতা জুয়েল আহমদ। এই মৌসুমে তারা দুইজনে ৭টি নৌকা বিক্রি করতে পারছেন বলে জানান। তবে তাদের দাবী এই শিল্প ও ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।