
গোয়াইনঘাট প্রতিনিধি:
সারা দেশের মানুষের কাছে সিলেটের জাফলংয়ের খ্যাতি নয়নাভিরাম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে। পাথর আর বালু লুটেরাদের লোভের শিকার হয়ে জনপ্রিয় এ পর্যটনকেন্দ্র এখন হুমকির মুখে। সিলেট শহর থেকে ৬২ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় সীমান্ত ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে পিয়াইন (ডাউকি) নদী। সেই নদী দিয়ে ভেসে আসা পাথর স্থানীয়দের আয়ের একটি বড় উৎস। সরকার জাফলংকে ইসিএ এলাকা ঘোষণা করলেও প্রশাসনের সামনেই জাফলংয়ে পাথর-বালু নিয়ে চলছে রামরাজত্ব।
স্থানীয়রা বলছেন, পাথর লুটের পর এখন সেখানে অবাধে বালু তোলার কারবার চলছে। প্রায় প্রতিদিনই বালু উত্তোলন করায় হুমকির মুখে পড়ছে নদী অববাহিকা, প্রাণবৈচিত্র্য।প্রশাসন ও বিএনপির নাম ভাঙিয়ে প্রতিদিন চাঁদাও উঠছে।
জাফলং বাজারের কয়েক জন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় , অগাস্টে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর একটি চক্র প্রথমে জাফলং পর্যটন কেন্দ্রের আশপাশে থাকা পাথর লুট শুরু করে। স্থানীয় প্রশাসনকে ‘ম্যানেজ’ করে তারা এখন বালু লুট করছে। প্রতিদিন শত শত ট্রাক বালু নদী থেকে তুলে বিভিন্ন স্থানে মজুদ করা হচ্ছে। সোমবার (২৮ জুলাই) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বালুবাহী কয়েক শতাধিক ট্রাকে জাফলং নদীর বুকে তীব্র যানযটের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করতেই গোয়াইনঘাট থানার অফিসার ইনচার্জ সরকার তোফায়েলের কণ্ঠে ফুটল অসহায়ত্ব। তার ভাষ্য, অভিযান চালিয়েও তারা কিছু করতে পারছেন না। উপজেলা প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা বললেন, জাফলংয়ে বালু উত্তোলন বন্ধ করতে একদিনের অভিযান পরিচালনার জন্য অন্তত ‘কয়েক হাজার’ লোকবল দারকার, বাস্তবে যা প্রায় অসম্ভব। কম লোক নিয়ে অভিযানে গেলে উল্টো ‘আক্রমণের’ শিকার হওয়ার আশঙ্কা থাকে। অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলনের ঘটনায় উপজেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও পুলিশের পক্ষ থেকে দেড় ডজনেরও বেশি মামলা হয়েছে গত এক বছরে । এসব মামলার আসামিদের মধ্যে সিলেট জেলা বিএনপির সদ্য সাবেক যুগ্ম সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরাণ সহ জাফলংয়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গরা আসামি রয়েছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, এরাই জাফলংয়ের বালু উত্তোলন চক্রের ‘হোতা’। অভিযোগ ওঠার পর শাহপরাণের পদ স্থগিত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, বেলার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে জাফলংকে পরিবেশ-প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করা হয়। এছাড়া পাথর কোয়ারির মূল কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডিসি) উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জাফলংসহ সিলেটের আটটি পাথর কোয়ারিতে পাথর উত্তোলন বন্ধ রাখে। বিএমডিসির ওই সিদ্ধান্ত জেলা প্রশাসন কার্যকর করায় ভারতের নদ-নদীর পানির স্রোতে আসা পাথর আবার জাফলং ও ভোলাগঞ্জে জমতে শুরু করে। গত চার বছরে জমা এসব পাথরই এখন লুটপাট হচ্ছে। বর্তমানে প্রতিদিন চার থেকে পাঁচ হাজার বারকি নৌকা দিয়ে বালু উত্তোলন চলছে। বারকি শ্রমিকেরা প্রতি ফুট বালু ১০ টাকা করে নদীর পাড়ে বিক্রি করেন। ব্যবসায়ীরা সেই বালু কিনে নিজেদের সুবিধামত জায়গায় মজুদ করেন। পরে সেই বালু যায় দেশের বিভিন্ন স্থানে।
গোয়াইনঘাটের ব্যবসায়ীদের কথায় দুই বিএনপি নেতার পাশাপাশি জাফলং বালু ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দিলোয়ার হোসেন দিলু ও ট্রাক ড্রাইভার সমিতির সভাপতি সমেদ মিয়ার নামও এসেছে। পাথর ওঠানোর প্রতিটি বোমা মেশিন থেকে ২৫০০ টাকা, আর ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৫০০ টাকা করে তোলা হচ্ছে বলেও তাদের ভাষ্য। জাফলং বাজারের ব্রিজ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ডাউকি নদীর বাজার তীরবর্তী পাড়ে বারকি নৌকা থেকে পাথর নামাচ্ছেন শ্রমিকরা। নদীর উত্তর দিকে অন্তত ৫০টি ‘বোমা মেশিন’ দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে নৌকায়। নির্বিচারে বালু ও পাথর তোলায় ব্রিজের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। নদীর পশ্চিমপাড় সংলগ্ন জাফলং চা বাগান পাড়ে দেখা দিয়েছে ভাঙন। নদীর জাফলং ব্রিজ থেকে শুরু করে মামার দোকান এলাকা, বল্লাঘাট ও জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত এভাবে বালু-পাথর উত্তোলন করতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি বারকি নৌকা দেখা গেছে বল্লাঘাট ও মামার দোকান এলাকায়। তিন থেকে পাঁচ হাজার বারকি নৌকা দিয়ে বালু তোলা হচ্ছে পিয়াইন নদীর দুই পাড় থেকে। প্রতিটি বারকি নৌকায় দুজন করে শ্রমিক কাজ করেন। নদীর প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকার এপাড়-ওপাড় থেকে অবাধে চলছে বালু উত্তোলন। আর নদীর পাড়েই রাখা হয়েছে বালু পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাকগুলো। নদী তীরবর্তী ক্র্যাশার মিলগুলোতে বালু-পাথর স্তূপ করে রাখতে দেখা গেছে। জাফলং বাজারের ব্রিজ এলাকায় কথা হয় বালু ব্যবসায়ী আকরাম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, নদীর ব্রিজ এলাকার প্রতি ফুট বালু ১৭ টাকা করে বিক্রি করা হয়। আর জিরো পয়েন্ট এলাকার বালু ২০ থেকে ২২ টাকা দরে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। “বড় ব্যবসায়ীরা নদী পাড়ে বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে বালু কিনে নেয়, পরে ট্রাকে করে সাইটে নিয়ে বিক্রি করেন। এখন পাথর তোলা হচ্ছে না। তবে ব্রিজ এলাকায় গেলে কিছু পাথর পাবেন। গত কিছুদিন আগে শ্রমিকেরা পাথর তুলেছে; এ মৌসুমের পাথর ওঠানো শেষ হওয়ায় বর্তমানে বালু চলছে।’’
Channel Jainta News 24 






















