ঢাকা ০৫:২৬ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৫, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

এসআই মারুফ’র নেতৃত্বে “জাফংলয়ে গড়ে উঠেছে বালু লুট- চৌরাচালান সিন্ডিকেট

  • Channel Jainta News 24
  • প্রকাশিত: ০৬:৩২:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
  • ১০ পড়া হয়েছে
১৯

আব্দুল হালিম সাগর:: জাফলং সীমান্তে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে লক্ষ-লক্ষ শ্রমিক। যারা এক সময় সনাতন পদ্ধতিতে জাফলং নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করে তাদের পরিবারের জিবীকা নির্বাহ করতো। কিন্তু বালু-পাথর খেকোদের জন্য এখন তারা বেকার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পাথর কোয়ারী খোলে দেয়ার দাবীতে কতো আন্দোলন, সংবাদ সম্মেলন, স্বারকলীপি দেওয়া হলো, কিন্তু কোন কাজেই আসেনি এসব। বরং সরকারের পক্ষ থেকে জারী করা হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। নতুন জেলা প্রশাসক যোগদানের পর সব কয়টি পাথর কোয়ারী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন একদম বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারী দিয়ে মিশন শুরু করেন। কোয়ারী সংশ্লিষ্ট সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশদেন বালু-পাথর লুটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। একই নির্দেশ দেন সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি ও বিভাগীয় কমিশনার। তাই বলে কি বন্ধ রয়েছে জাফলং এলাকায় বালু পাথর-লুট-পাট দিনের আলোয় সব ফিটফাট থাকলে রাত হলে পাল্টে যাচ্ছে জাফলং এলাকার দৃশ্যপট। এতো নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাতে চলছে জাফলং এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন।

 

ও চোরাচালান। যদিও রাতে বালু লুটে সংবাদ প্রকাশের পর গত চলতি মাসের ৩ তারিখ রাতে মাঠে নামে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। সেই অভিযানে আটক করা হয় কয়েকটি নৌকা ও স্টককৃত কয়েক লাখ ঘণফুট বালু। কিন্তু আটক করা হয়নি বালু লুটে জড়িত কাউকে। গোয়াইনঘাট থানার নতুন ওসি তরিকুল ইসলাম যোগদানের পর স্থানীয় লোকজন মনে করছিলেন এবার হয়তো সরকার তোফায়েল যোগের অবসান হবে। একযোগে কয়েকজন বিট অফিসারকে বিভিন্ন থানায় বদলী করা হয়। কিন্তু এতো নির্দেশনা আর উপজেলা প্রশাসনের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও জাফলং নয়াবস্তি গ্রামের মৃত মোস্তফা মিয়ার ছেলে হাবিবুল্লাহ (ওরফে হাবুল্লা)। ছৈলাখেল গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে মানিক উরফে কালো মানিক। স্থানীয় যুবদল নেতা মাহমুদসহ জাফলং (নলজুরি ফাঁড়ির ইনচার্জ) বিট অফিসার এসআই মারুফ আহমদের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছেন একটি বালু-লুপাটের নতুন সিন্ডিকেট। উল্লেখিত সকলেই এসআই মারুফের নিয়োগকৃত পুলিশের নতুন লাইনম্যান। এরা নদীতে থেকে বালু উত্তোলনে আসা বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে পুলিশের নামে লাইনের টাকা তুলেন। সামান্য বারকি শ্রমিকরা তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। প্রতিটি নৌকা থেকে ৫শ টাকা করে পুলিশের লাইনের টাকা দিতে হয় তাদের। টাকা না দিলে নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। রাত হলে জাফলং জিরো পয়েন্টের আশপাশ, জাফলং চা বাগান এলাকায় জড়ো করা হয় কয়েকশত ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এসব নৌকা দিয়ে নদী থেকে অবৈধ ভাবে ইসিএ এলাকা থেকে লাখ-লাখ ঘণফুট বালু উত্তোলন অন্য স্থানে স্টক করা হয়। ভোর হওয়ার পরই তাদের বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র এক বছর আগেও হাবিবুল্লাহ ছিলো সামান্য একজন বারকি শ্রমিক। সে ছিলো জাফলং পাথর লুটের একজন সক্রিয় সদস্য। স্থানীয় প্রশাসন থানার ওসির সাথে সম্পর্ক তৈরী করে দিনে-রাতে অবৈধ ভাবে উত্তোলন করতো। পাথর লুটে প্রশাসনিক অভিযান হলেও সে কিংবা তার বাহিনী সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কয়েকদিন লাগাতার প্রশাসনের অভিযানে পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও বারকি শ্রমিক নেতা হাবিবুল্লা ঠিকই মাঠে ছিলো। বারকি শ্রমিকদের মজুদ করা জমিদার মসজিদের পাশ ও জাফলং চা বাগান এলাকার নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তলোন করা শুরু করেন তিনি ও তার চক্রের সদস্যরা। মাত্র কয়েক মাসে হাবিবুল্লাহ এখন ৮টি ড্রেজার মেশিন, দুটি সেভ মেশিন, ক্রাশার মিলের মালিকসহ বাড়িতে বানিয়েছেন বিশাল অট্টালিকা। সব মিলয়ে হবিবুল্লাহ এখন ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

 

বারকি শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, জাফলং বাজারের জমিদার মসজিদের পাশে নদী থেকে বারকি শ্রমিকরা বালু তুলে মজুদ করেন। সেই মজুদ করা বালু বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। সেখানে নতুন করে পুলিশের গোয়াইনঘাট থানার ওসি তরকুিল ইসলাম ও স্থানীয় ফাঁড়ির আইসি এসআই মারুফ আহমদের নামে চাঁদা তুলেন হাবিবুল্লাহ, মানিক ও যুবদল নেতা মাহমুদ। মানিক উরফে কালো মানিক। গত বছরের ৫ই আগস্টের পূর্বে ছিলো বারকি নৌকা সমিতির সভাপতি। সেই পদকে কাজে লাগিয়ে তিনিও এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। এরা এতো কৌশলী প্রশাসনের কোন অভিযান হলে নিজেদের ক্ষমতা বুঝানোর জন্য অভিযানের সময় পুলিশের সাথে তাদের দেখা মেলে। যাতে সকলে বুঝতে পারে এরা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই লাইনের টাকা তুলছে।

 

শ্রমিকরা জানান, যখনই নদীতে প্রশাসন কোন অভিযানে যায়, সেই অভিযানের জন্য নৌকা ভাড়া করে দেন লাইনম্যান মানিক। আর মানিকের বিশ্বস্থ নৌকা চালক সোহেল সকল নৌকার বন্ধবস্ত করেন।

 

শ্রমিকরা ক্ষোভের সাথে জানান, নদী থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বালু তুলে জমিদারঘাটে নিয়ে আসার পর পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হয় অর্ধেক দামে। কারন ক্রেতারা বালু নিয়ে যাবার সময় হাবিবুল্লাহ বাহিনীকে প্রতিটি গাড়ি থেকে হয় চাঁদা। চাঁদা না দিলেই ফাঁড়ির পুলিশ দিয়ে গাড়িসহ বালি জব্দ করানো হয়। যে গাড়ি তাদের চাঁদা দেয়, সেটিই নির্বিঘ্নে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়। জমিদার মসজিদের পাশ থেকে প্রতি ট্রাক থেকে ১ হাজার টাকা এবং ট্রাক্টর থেকে ৫শত টাকা করে চাঁদা তুলেন হাবিবুল্লাহ ও মানিক বাহি-নী। কারণ জাফলং ফাঁড়ির পুলিশ সরাসরি এসব চাঁদাবাজীতে জড়িত।

 

এসব দিনের দৃশ্য। রাত ৭টা হলেই জাফলংয়ের চা বাগান এলাকায় হাবুবল্লাহ, কালো মানিক ও মাহবুবের নেতৃত্বে ভোর পর্যন্ত চলে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন। উপজেলা প্রশাসন অভিযানে নামার আগেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে যায় পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে। ফলে অভিযানে গিয়ে বালু পাওয়া গেলে বালু লোটকারীদের পাওয়া যায়না। সীমান্তের চোরাচালান: গোয়াইনঘাট সীমান্তের জাফলং এলাকা দিয়ে দেশে প্রবেশ সব চেয়ে বেশী ভারতীয় চোরাচালানের পণ্য। প্রতিমাসেই সিলেট বিভাগীয় কমিশনারে অফিসে বসে চোরাচালান বিরোধী টান্সফোর্সে সভা। একই ভাবে প্রতিমাসে রেজ ডিআইজির কার্যালয়ে প্রতিমাসে বসে মাসিক অপরাধ পর্যালোনা সভা। পুলিশ সুপার অফিসেই আইনশৃংখলা সভাতো আছেই প্রতিমাসে। প্রতিটি সভায় কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয় সীমান্তের চোরাচালান বন্ধের। কিন্তু আসলে কি সীমান্তের চোরাচালান কখনো বন্ধ হয়েছে সপ্তাহে দু-একটি চোরাচালানের পণ্য আটকের খবর দেয় বিজিবি। তারপর সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে আসছে অবৈধ হরেক রকম পন্যসহ মাদক-অস্ত্র। শুধু গোয়াইনঘাটের জাফলং সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন দেশে প্রবেশ করে কোটি টাকার চোরাইপণ্য।

 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মান্নান, যুবদল থেকে বহিষ্কৃত নেতা আবুল কাশেমের ডান হাত হিসাবে পরিচিত বাবলা এখন জাফলং ইউনিয়নের চোরাচালান স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও আবুল কাশেম নিজেকে সব সময় নিরোপরাধ দাবী করে আসছেন। জাফলং সংগ্রাম ক্যাম্পের লালমাটি এলাকা দিয়ে দিনে-রাতে ভারতীয় অবৈধ পণ্য দেশে প্রবেশ করছে। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই মান্নান ও তার সহযোগীদের মালিকানাধীন কয়েকটি দোকানঘর। এসব দোকানে অবৈধ ভারতীয় পণ্য মজুদ থাকলেও কোনো অভিযান হয় না এখানে। প্রতিরাতেই সিলেট সীমান্তে বিজিবি ও পুলিশের সামনেই ভারত থেকে নামছে চোরাচালানের এসব পণ্য। এসব চোরাচালানে শুধু ভারতীয় পণ্যই থাকছে না, আসছে অস্ত্র ও নিষিদ্ধ হরেক রকম মাদক। কয়েকদিন আগে এরকম একটি অস্ত্রের চালান পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বিজিবি। কিন্তু সে ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি তারা। জাফলং তামাবিল, সোনাটিলা, স্থলবন্দর, নলজুড়ি, বল্লাঘাট জিরো পয়েন্ট, আমস্বপ্ন ও তালতলা, লালমাটি, নলজুরি, সংগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প, বিজিবি ক্যান্টিন, সাইনবোর্ড, আমতলা এলাকা দিয়ে আসে এসব ভারতীয় পণ্য। এসব চোরাচালানের পণ্য থেকে টাকা আদায় করার জন্য জাফলং ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মারুফের রয়েছে নিজস্ব নিয়োগকৃত লোকজন। এক দিকে মান্নান মেম্বার, অপর দিকে বাবলা। তবে দুজনের আবার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। এরা দিনে রাতে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় টহল দিতে থাকে। আবার বিভিন্ন পয়েন্টে কালো ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে মান্নান ও বাবলার লোক। তাদের কাছে বিজিবি ও ফাঁড়ি পুলিশের লাইনের টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।

 

এ ব্যাপারে স্থানীয় নলজুড়ি (জাফলং বিট) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মারুফ আহমদ অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন, জনবল কম, এলাকা অনেক বড়। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এসব বন্ধ করতে। এসআই মারুফ আহমদ এএসআই থাকা অবস্থায় বিগত আওয়ামী লীগের শাসন আমলে জাফলংয়ের এই বিটে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সেই সময় এসব বিস্তর অভিযোগ ছিলো। নতুন পদন্নোতী হওয়ার পর সেই চিরোচেনা জায়গায় ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পান মারুফ আহমদ। তাই ঐ এলাকার সকল ধরনের অপরাধী ও অপরাধ স্পট সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। জাফলং বিট হিসাবে যোগদানের পরই গড়ে তুলেছেন তার পুরাতন অপরাধীদের নিয়ে নতুন সিন্ডিকেট। আমলে নিচ্ছেন না ডিআইজি কিংবা ডিসির কোন নির্দেশনা। মারুফের কাছে প্রশ্ন ছিলো, সিলেট জেলা প্রশাসক ও ডিআইজি ও পুলিশ সুপারের এতো কঠিন নির্দেশ থাকার পরও কি করে এই সিন্ডিকেট অবৈধ ভাবে স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও চোরাকারবার চলছে। তখনই মারুফ ফোনের লাইন কেটে দেন।

 

সিলেট জেলা প্রশাসক বলেন, যেহেতু সিলেট জেলা সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনায় এলাকা থেকে কতিপয় ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সংরক্ষন, পরিবহন, লুণ্ঠন ও পাচারের সাথে জড়িত রয়েছেন এবং যেহেতু প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেহেতু সিলেট জেলা অবৈধভাবে বালু পাথর উত্তোলন সংরক্ষণ পরিবহন ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গত ২৫ আগষ্ট থেকে। আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

 

সূত্র দৈনিক চিত্র :১২ অক্টোবর ২০২৫

ট্যাগ:

কমেন্ট লিখুন

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনি কমেন্ট করতে ইচ্ছুক?

সাংবাদিকদের তথ্য
ডেস্ক নিউজ

ডেস্ক নিউজ

জনপ্রিয় সংবাদ

জৈন্তাপুরে দাঁড়িপাল্লার সমর্থনে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত

Follow for More!

এসআই মারুফ’র নেতৃত্বে “জাফংলয়ে গড়ে উঠেছে বালু লুট- চৌরাচালান সিন্ডিকেট

প্রকাশিত: ০৬:৩২:৩৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২০ অক্টোবর ২০২৫
১৯

আব্দুল হালিম সাগর:: জাফলং সীমান্তে বেকার হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে লক্ষ-লক্ষ শ্রমিক। যারা এক সময় সনাতন পদ্ধতিতে জাফলং নদী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন করে তাদের পরিবারের জিবীকা নির্বাহ করতো। কিন্তু বালু-পাথর খেকোদের জন্য এখন তারা বেকার মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। পাথর কোয়ারী খোলে দেয়ার দাবীতে কতো আন্দোলন, সংবাদ সম্মেলন, স্বারকলীপি দেওয়া হলো, কিন্তু কোন কাজেই আসেনি এসব। বরং সরকারের পক্ষ থেকে জারী করা হয়েছে কঠোর নির্দেশনা। নতুন জেলা প্রশাসক যোগদানের পর সব কয়টি পাথর কোয়ারী থেকে বালু-পাথর উত্তোলন একদম বন্ধ করে দেওয়ার হুশিয়ারী দিয়ে মিশন শুরু করেন। কোয়ারী সংশ্লিষ্ট সকল উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে নির্দেশদেন বালু-পাথর লুটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের। একই নির্দেশ দেন সিলেট রেঞ্জ ডিআইজি ও বিভাগীয় কমিশনার। তাই বলে কি বন্ধ রয়েছে জাফলং এলাকায় বালু পাথর-লুট-পাট দিনের আলোয় সব ফিটফাট থাকলে রাত হলে পাল্টে যাচ্ছে জাফলং এলাকার দৃশ্যপট। এতো নির্দেশনাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে রাতে চলছে জাফলং এলাকায় অবৈধ বালু উত্তোলন।

 

ও চোরাচালান। যদিও রাতে বালু লুটে সংবাদ প্রকাশের পর গত চলতি মাসের ৩ তারিখ রাতে মাঠে নামে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন। সেই অভিযানে আটক করা হয় কয়েকটি নৌকা ও স্টককৃত কয়েক লাখ ঘণফুট বালু। কিন্তু আটক করা হয়নি বালু লুটে জড়িত কাউকে। গোয়াইনঘাট থানার নতুন ওসি তরিকুল ইসলাম যোগদানের পর স্থানীয় লোকজন মনে করছিলেন এবার হয়তো সরকার তোফায়েল যোগের অবসান হবে। একযোগে কয়েকজন বিট অফিসারকে বিভিন্ন থানায় বদলী করা হয়। কিন্তু এতো নির্দেশনা আর উপজেলা প্রশাসনের কঠোর নিষেধাজ্ঞার পরও জাফলং নয়াবস্তি গ্রামের মৃত মোস্তফা মিয়ার ছেলে হাবিবুল্লাহ (ওরফে হাবুল্লা)। ছৈলাখেল গ্রামের সিরাজ মিয়ার ছেলে মানিক উরফে কালো মানিক। স্থানীয় যুবদল নেতা মাহমুদসহ জাফলং (নলজুরি ফাঁড়ির ইনচার্জ) বিট অফিসার এসআই মারুফ আহমদের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছেন একটি বালু-লুপাটের নতুন সিন্ডিকেট। উল্লেখিত সকলেই এসআই মারুফের নিয়োগকৃত পুলিশের নতুন লাইনম্যান। এরা নদীতে থেকে বালু উত্তোলনে আসা বারকি শ্রমিকদের কাছ থেকে পুলিশের নামে লাইনের টাকা তুলেন। সামান্য বারকি শ্রমিকরা তাদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেনা। প্রতিটি নৌকা থেকে ৫শ টাকা করে পুলিশের লাইনের টাকা দিতে হয় তাদের। টাকা না দিলে নৌকা ডুবিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। রাত হলে জাফলং জিরো পয়েন্টের আশপাশ, জাফলং চা বাগান এলাকায় জড়ো করা হয় কয়েকশত ইঞ্জিন চালিত নৌকা। এসব নৌকা দিয়ে নদী থেকে অবৈধ ভাবে ইসিএ এলাকা থেকে লাখ-লাখ ঘণফুট বালু উত্তোলন অন্য স্থানে স্টক করা হয়। ভোর হওয়ার পরই তাদের বালু উত্তোলন বন্ধ হয়ে যায়। মাত্র এক বছর আগেও হাবিবুল্লাহ ছিলো সামান্য একজন বারকি শ্রমিক। সে ছিলো জাফলং পাথর লুটের একজন সক্রিয় সদস্য। স্থানীয় প্রশাসন থানার ওসির সাথে সম্পর্ক তৈরী করে দিনে-রাতে অবৈধ ভাবে উত্তোলন করতো। পাথর লুটে প্রশাসনিক অভিযান হলেও সে কিংবা তার বাহিনী সব সময় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। কয়েকদিন লাগাতার প্রশাসনের অভিযানে পাথর উত্তোলন বন্ধ হলেও বারকি শ্রমিক নেতা হাবিবুল্লা ঠিকই মাঠে ছিলো। বারকি শ্রমিকদের মজুদ করা জমিদার মসজিদের পাশ ও জাফলং চা বাগান এলাকার নদী থেকে মেশিন দিয়ে বালু উত্তলোন করা শুরু করেন তিনি ও তার চক্রের সদস্যরা। মাত্র কয়েক মাসে হাবিবুল্লাহ এখন ৮টি ড্রেজার মেশিন, দুটি সেভ মেশিন, ক্রাশার মিলের মালিকসহ বাড়িতে বানিয়েছেন বিশাল অট্টালিকা। সব মিলয়ে হবিবুল্লাহ এখন ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার সম্পদের মালিক।

 

বারকি শ্রমিকরা অভিযোগ করেন, জাফলং বাজারের জমিদার মসজিদের পাশে নদী থেকে বারকি শ্রমিকরা বালু তুলে মজুদ করেন। সেই মজুদ করা বালু বিক্রি করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন তারা। সেখানে নতুন করে পুলিশের গোয়াইনঘাট থানার ওসি তরকুিল ইসলাম ও স্থানীয় ফাঁড়ির আইসি এসআই মারুফ আহমদের নামে চাঁদা তুলেন হাবিবুল্লাহ, মানিক ও যুবদল নেতা মাহমুদ। মানিক উরফে কালো মানিক। গত বছরের ৫ই আগস্টের পূর্বে ছিলো বারকি নৌকা সমিতির সভাপতি। সেই পদকে কাজে লাগিয়ে তিনিও এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। এরা এতো কৌশলী প্রশাসনের কোন অভিযান হলে নিজেদের ক্ষমতা বুঝানোর জন্য অভিযানের সময় পুলিশের সাথে তাদের দেখা মেলে। যাতে সকলে বুঝতে পারে এরা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই লাইনের টাকা তুলছে।

 

শ্রমিকরা জানান, যখনই নদীতে প্রশাসন কোন অভিযানে যায়, সেই অভিযানের জন্য নৌকা ভাড়া করে দেন লাইনম্যান মানিক। আর মানিকের বিশ্বস্থ নৌকা চালক সোহেল সকল নৌকার বন্ধবস্ত করেন।

 

শ্রমিকরা ক্ষোভের সাথে জানান, নদী থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বালু তুলে জমিদারঘাটে নিয়ে আসার পর পাইকারের কাছে বিক্রি করতে হয় অর্ধেক দামে। কারন ক্রেতারা বালু নিয়ে যাবার সময় হাবিবুল্লাহ বাহিনীকে প্রতিটি গাড়ি থেকে হয় চাঁদা। চাঁদা না দিলেই ফাঁড়ির পুলিশ দিয়ে গাড়িসহ বালি জব্দ করানো হয়। যে গাড়ি তাদের চাঁদা দেয়, সেটিই নির্বিঘ্নে নিজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়। জমিদার মসজিদের পাশ থেকে প্রতি ট্রাক থেকে ১ হাজার টাকা এবং ট্রাক্টর থেকে ৫শত টাকা করে চাঁদা তুলেন হাবিবুল্লাহ ও মানিক বাহি-নী। কারণ জাফলং ফাঁড়ির পুলিশ সরাসরি এসব চাঁদাবাজীতে জড়িত।

 

এসব দিনের দৃশ্য। রাত ৭টা হলেই জাফলংয়ের চা বাগান এলাকায় হাবুবল্লাহ, কালো মানিক ও মাহবুবের নেতৃত্বে ভোর পর্যন্ত চলে অবৈধ ভাবে বালু উত্তোলন। উপজেলা প্রশাসন অভিযানে নামার আগেই তাদের কাছে খবর পৌঁছে যায় পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে। ফলে অভিযানে গিয়ে বালু পাওয়া গেলে বালু লোটকারীদের পাওয়া যায়না। সীমান্তের চোরাচালান: গোয়াইনঘাট সীমান্তের জাফলং এলাকা দিয়ে দেশে প্রবেশ সব চেয়ে বেশী ভারতীয় চোরাচালানের পণ্য। প্রতিমাসেই সিলেট বিভাগীয় কমিশনারে অফিসে বসে চোরাচালান বিরোধী টান্সফোর্সে সভা। একই ভাবে প্রতিমাসে রেজ ডিআইজির কার্যালয়ে প্রতিমাসে বসে মাসিক অপরাধ পর্যালোনা সভা। পুলিশ সুপার অফিসেই আইনশৃংখলা সভাতো আছেই প্রতিমাসে। প্রতিটি সভায় কঠোরভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয় সীমান্তের চোরাচালান বন্ধের। কিন্তু আসলে কি সীমান্তের চোরাচালান কখনো বন্ধ হয়েছে সপ্তাহে দু-একটি চোরাচালানের পণ্য আটকের খবর দেয় বিজিবি। তারপর সীমান্ত দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ভারত থেকে আসছে অবৈধ হরেক রকম পন্যসহ মাদক-অস্ত্র। শুধু গোয়াইনঘাটের জাফলং সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন দেশে প্রবেশ করে কোটি টাকার চোরাইপণ্য।

 

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ড সদস্য আব্দুল মান্নান, যুবদল থেকে বহিষ্কৃত নেতা আবুল কাশেমের ডান হাত হিসাবে পরিচিত বাবলা এখন জাফলং ইউনিয়নের চোরাচালান স্পটগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। যদিও আবুল কাশেম নিজেকে সব সময় নিরোপরাধ দাবী করে আসছেন। জাফলং সংগ্রাম ক্যাম্পের লালমাটি এলাকা দিয়ে দিনে-রাতে ভারতীয় অবৈধ পণ্য দেশে প্রবেশ করছে। স্থানীয় বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই মান্নান ও তার সহযোগীদের মালিকানাধীন কয়েকটি দোকানঘর। এসব দোকানে অবৈধ ভারতীয় পণ্য মজুদ থাকলেও কোনো অভিযান হয় না এখানে। প্রতিরাতেই সিলেট সীমান্তে বিজিবি ও পুলিশের সামনেই ভারত থেকে নামছে চোরাচালানের এসব পণ্য। এসব চোরাচালানে শুধু ভারতীয় পণ্যই থাকছে না, আসছে অস্ত্র ও নিষিদ্ধ হরেক রকম মাদক। কয়েকদিন আগে এরকম একটি অস্ত্রের চালান পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে বিজিবি। কিন্তু সে ঘটনায় কাউকে আটক করতে পারেনি তারা। জাফলং তামাবিল, সোনাটিলা, স্থলবন্দর, নলজুড়ি, বল্লাঘাট জিরো পয়েন্ট, আমস্বপ্ন ও তালতলা, লালমাটি, নলজুরি, সংগ্রাম বিজিবি ক্যাম্প, বিজিবি ক্যান্টিন, সাইনবোর্ড, আমতলা এলাকা দিয়ে আসে এসব ভারতীয় পণ্য। এসব চোরাচালানের পণ্য থেকে টাকা আদায় করার জন্য জাফলং ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মারুফের রয়েছে নিজস্ব নিয়োগকৃত লোকজন। এক দিকে মান্নান মেম্বার, অপর দিকে বাবলা। তবে দুজনের আবার রয়েছে নিজস্ব বাহিনী। এরা দিনে রাতে মোটর সাইকেল নিয়ে রাস্তায় টহল দিতে থাকে। আবার বিভিন্ন পয়েন্টে কালো ব্যাগ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে মান্নান ও বাবলার লোক। তাদের কাছে বিজিবি ও ফাঁড়ি পুলিশের লাইনের টাকা বুঝিয়ে দিতে হয়।

 

এ ব্যাপারে স্থানীয় নলজুড়ি (জাফলং বিট) পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই মারুফ আহমদ অভিযোগের কথা স্বীকার করে বলেন, জনবল কম, এলাকা অনেক বড়। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি এসব বন্ধ করতে। এসআই মারুফ আহমদ এএসআই থাকা অবস্থায় বিগত আওয়ামী লীগের শাসন আমলে জাফলংয়ের এই বিটে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে সেই সময় এসব বিস্তর অভিযোগ ছিলো। নতুন পদন্নোতী হওয়ার পর সেই চিরোচেনা জায়গায় ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পান মারুফ আহমদ। তাই ঐ এলাকার সকল ধরনের অপরাধী ও অপরাধ স্পট সম্পর্কে তার স্পষ্ট ধারণা রয়েছে। জাফলং বিট হিসাবে যোগদানের পরই গড়ে তুলেছেন তার পুরাতন অপরাধীদের নিয়ে নতুন সিন্ডিকেট। আমলে নিচ্ছেন না ডিআইজি কিংবা ডিসির কোন নির্দেশনা। মারুফের কাছে প্রশ্ন ছিলো, সিলেট জেলা প্রশাসক ও ডিআইজি ও পুলিশ সুপারের এতো কঠিন নির্দেশ থাকার পরও কি করে এই সিন্ডিকেট অবৈধ ভাবে স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করে বালু উত্তোলনের পাশাপাশি চাঁদাবাজি ও চোরাকারবার চলছে। তখনই মারুফ ফোনের লাইন কেটে দেন।

 

সিলেট জেলা প্রশাসক বলেন, যেহেতু সিলেট জেলা সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন সম্ভাবনায় এলাকা থেকে কতিপয় ব্যক্তি অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সংরক্ষন, পরিবহন, লুণ্ঠন ও পাচারের সাথে জড়িত রয়েছেন এবং যেহেতু প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ পর্যটন সম্ভাবনাময় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সমুহ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে সেহেতু সিলেট জেলা অবৈধভাবে বালু পাথর উত্তোলন সংরক্ষণ পরিবহন ও বিক্রয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে গত ২৫ আগষ্ট থেকে। আদেশ অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।

 

সূত্র দৈনিক চিত্র :১২ অক্টোবর ২০২৫