জাহিদুল ইসলাম :: উত্তর সিলেটের জনপ্রিয় জনপদ জৈন্তিয়ার অতল ইতিহাসকে তুলে আনতে যারা কাজ করছেন, তাদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল একটি নাম আসিফ আযহার। লেখক, গবেষক, শিক্ষক ও সমাজকর্মী-এই চারটি পরিচয়েই তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তবে তাঁর বড় পরিচয়-"জৈন্তিয়া রাজ্যের ইতিকথা" গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে।
জন্ম ও শৈশব:
১৯৯২ সালে জন্ম সিলেট শহরে। তাঁর শেকড় কানাইঘাট উপজেলার রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের মির্জারগড় গ্রামে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে ২০০৯ সালে বর্ডার গার্ড পাবলিক হাইস্কুল থেকে এসএসসি ও ২০১১ সালে মদন মোহন কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ফার্স্ট ক্লাসে স্নাতক শেষ করেন।
পেশাগত জীবন:
বাংলাদেশ থেকে ব্রিটেন প্রথমে সীমান্তিক নার্সিং ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে পাড়ি জমান যুক্তরাজ্যে। সেখানকার নর্দান আয়ারল্যান্ডের আলস্টার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দুই বছর মেয়াদী মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। একইসঙ্গে, যুক্তরাজ্য সরকারের স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা NHS-এ কর্মজীবন শুরু করেন। কাজ করেছেন বার্মিংহামের কুইন এলিজাবেথ হাসপাতাল, হার্টল্যান্ড হাসপাতাল ও সলিহাল হাসপাতাল-এ। বর্তমানে NHS-এর অভিজ্ঞ অপারেটিভ হিসেবে নবীনদের প্রশিক্ষণেও যুক্ত আছেন।
মানবাধিকার ও সমাজকর্ম:
আসিফ আযহার শুধু ইতিহাসবিদ নন, তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। যুক্তরাজ্যে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সদস্য হিসেবে ফিলিস্তিনের গণহত্যার প্রতিবাদসহ নানান কর্মসূচিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশের আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক) ফাউন্ডেশন, কানাইঘাট শাখার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করছেন।
করোনা মহামারীতে, অপরাধ বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কানাইঘাটের ১২৪টি সামাজিক সংগঠন নিয়ে গঠন করেন সম্মিলিত সামাজিক জোট।
সংগঠন ও নেতৃত্ব:
তিনি অনেকগুলো সামাজিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা, যার মধ্যে রয়েছে: কানাইঘাট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন, কানাইঘাট সাস্টিয়ান ফোরাম, প্রগতিশীল পাঠকসংঘ শৈলী, পেন ক্লাব।
২০২৩ সালে বৃহত্তর জৈন্তিয়ার দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করেন "জৈন্তিয়া ১৭ পরগনা ছাত্রজোট"। এর অধীনে রয়েছে:
জৈন্তিয়া ছাত্র পরিষদ (যুক্তরাজ্য),
কানাইঘাট স্টুডেন্ট এসোসিয়েশন,
জৈন্তাপুর উপজেলা ছাত্রকল্যাণ পরিষদ, বাতায়ন, গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ ছাত্র পরিষদ (কোছাপ)।
বর্তমানে তিনি জৈন্তিয়া ছাত্র পরিষদ (যুক্তরাজ্য)-এর সভাপতি এবং জৈন্তিয়া কেন্দ্রীয় ছাত্র পরিষদের সিনিয়র সহ-সভাপতি।
মানবসেবা ও উন্নয়ন কাজ:
CAP ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা হিসেবে, কানাইঘাট উপজেলার লালারচক গ্রামে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন আসিফ আযহার।
তিনি বাস্তবায়ন করেন, বিশুদ্ধ পানির টিউবওয়েল, স্যানিটারি সুবিধা, প্রধান, সহ বিভিন্ন মানবকল্যাণ প্রকল্প।
শৈলীর অধীনে, সিলেট শহরের ২০টি স্কুলে কিশোর পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করেন, এছাড়া রাজাগঞ্জ ইউনিয়নের পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠায় তাঁর জোরালো ভূমিকা ছিল।
সাহিত্য ও ইতিহাসচর্চা:
তাঁর লেখা "জৈন্তিয়া রাজ্যের ইতিকথা" (২০২৪) গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে:
পার্বত্য ও সমতলের শাসনব্যবস্থা,
কৃষক রাজবংশ ও সিন্টেং রাজাদের ইতিহাস, মুলাগুল যুদ্ধ ও রামসিংহের প্রতিরোধ,ইংরেজদের বিশ্বাসঘাতকতা ও দখল, জৈন্তিয়ার নামের উৎপত্তি: সিন্টেং থেকে সুতংগা পর্যন্ত। এই বইকে জৈন্তার ইতিহাস পুনরুদ্ধারের একটি যুগান্তকারী কাজ হিসেবে ধরা হচ্ছে।
পুরস্কার নেন না, মানুষের ভালোবাসায় বিশ্বাস:
ব্যক্তিগত মতাদর্শগত কারণে আসিফ আযহার কোনো পুরস্কার, সংবর্ধনা বা সম্মাননা গ্রহণ করেন না। তবে তাঁর কর্ম ও চিন্তাধারা বহু তরুণের কাছে অনুপ্রেরণা।
ভবিষ্যৎ লক্ষ্য:
জৈন্তিয়ার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা,
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষা, বৃহত্তর জৈন্তিয়াবাসীর ন্যায্য দাবিগুলো তুলে ধরা, জৈন্তিয়া অঞ্চলে মানবাধিকার কার্যক্রম জোরদার করা, মেধাবী শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় সহায়তা করা।
আসিফ আজহার এর এ পর্যন্ত জৈন্তিয়া রাজ্যর ইতিকথা সহ ১২ টি বই রকমারি ডটকম সহ বিভিন্ন প্রকাশনীর মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে।
শেষ কথা:
আসিফ আযহার একজন মাটি ও মানুষের গবেষক। বই লিখে, সংগঠন গড়ে, হাসপাতালের দায়িত্ব পালন করে এবং মানুষের পাশে থেকে তিনি জৈন্তিয়ার ইতিহাস ও মানবিক উন্নয়নের গল্প রচনা করে চলেছেন। তাঁর জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়। প্রবাসেও বসে জন্মভূমির জন্য নিঃশব্দে বিপ্লব ঘটানো যায়।
আসিফ আজহার বর্তমানে দেশে অবস্থান করছেন জৈন্তিয়ার ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো পরিদর্শন করছেন এবং ভিডিও বার্তার মাধ্যমে সংগ্রহীত তথ্যগুলো প্রচার করছেন। তিনি তিনটি উপজেলা জুড়ে অবস্থিত প্রায় ১৮ টি ঐতিহাসিক প্রাচীন স্থাপনা গুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের প্রতি আহবান জানান। প্রাচীন এই সম্পদ গুলো রক্ষায় ক্যাটাগরি অনুযায়ী প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের আওতায় নিয়ে আসতে জানান।
এছাড়াও তিনি জৈন্তিয়া রাজ্যর ইতিহাস ঐতিহ্য রক্ষায় জৈন্তাপুর, কানাইঘাট ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সামাজিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সু-দৃষ্টি কামনা করছেন।